Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আন্দ্রে পিরলো: একজন স্থপতির জয়গান

সিগন্যাল ইদুনা পার্কের দর্শকদের স্নায়ুচাপ একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন। সেটা না হওয়ার অবশ্য কোনো কারণও নেই। খেলা শেষ হতে আর যে মাত্র কিছুক্ষণ বাকি। তারপরেই শুরু হবে টাইব্রেকার নামক এক ভাগ্য পরীক্ষা।

বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল মানেই বড় ম্যাচ, আর সেই ম্যাচে খেলছে নিজের দেশ। স্নায়ুচাপ বাড়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু বিশ্বকাপে জার্মানি-ইতালির ম্যাচ বাড়তি উত্তেজনা ছাড়া হয়েছে কবে? তাই তো গোলশূন্যভাবে শেষ হলো নির্ধারিত নব্বই মিনিটের খেলা। যেহেতু নকআউট ম্যাচ, দেয়া হলো তাই আরও বাড়তি ত্রিশ মিনিট।

সেই ত্রিশ মিনিটের আটাশ মিনিটেই ঘটনা ঘটে গেল। কর্নার থেকে বল এসে পড়লো জিলার্দিনোর কাছে, সেখান থেকে বল চলে গেল আন্দ্রে পিরলোর পায়ে। তাকে ট্যাকল করতে সামনে এগিয়ে গেল কয়েকজন জার্মান ডিফেন্ডার। কিন্তু তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে তিনি বল পাঠিয়ে দিলেন ডি-বক্সের ডান পাশে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা ফ্যাবিও গ্রসোর কাছে।

বল পায়ে আসতেই বাঁ পায়ে বাঁকানো শট নিলেন গ্রসো। সেই শট জার্মান গোলকিপার জেন্স লেম্যানকে দর্শক বানিয়ে জড়িয়ে গেল জালে।

গোল করেছিলেন গ্রসো, অ্যাসিস্ট করেছিলেন পিরলো। সেই ম্যাচে অসাধারণ খেলেছিলেন তিনি, হয়েছিলেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। শুধু তা-ই নয়, ফাইনাল ম্যাচেও ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ‘দ্য আর্কিটেক্ট’ নামের এই ফুটবলার।

সেই গোলের পর; Source: Goal.com

১৯৯৪ সালের কোনো একদিন। বাবার সাথে ব্রেসিয়া নামক ক্লাবের আঙিনায় পা রাখলেন আন্দ্রে পিরলো। প্রাথমিক অবস্থায় ব্রেসিয়া যুবদলে ঠাঁই হলো তার। সে সময় তিনি খেলতেন সেকেন্ডারি স্ট্রাইকার হিসেবে।

এর এক বছর পরে, ১৯৯৫ সালে সিরি আ-তে অভিষেক হয়ে গেল পিরলোর। তার বয়স তখন মাত্র ষোল বছর। নিয়মিত হতে পারলেন না অবশ্য, বরং আরও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য তাকে রাখা হলো যুবদলেই। সেখানে থাকতেই তিনি জিতলেন টর্নিও ডি ভায়ারেজ্জিও টুর্নামেন্ট। প্রচলিত এই টুর্নামেন্টকে যুবদলের জন্য অন্যতম সেরা বলে মনে করা হয়।

শৈশবের পিরলো; Source: lifebogger.com

গায়ে তখনও কৈশোরের গন্ধ; Source: worldfootballindex.com

পরের বছর থেকে ব্রেসিয়া সিনিয়র দলের হয়ে নিয়মিত খেলতে শুরু করলেন পিরলো। শুধু তা-ই নয়, সিরি বি-তে তখন রীতিমতো খাবি খাচ্ছিল ব্রেসিয়া, আগের মৌসুম শেষ করেছিল পয়েন্ট টেবিলের ১৬তম স্থানে থেকে। পিরলো এসেই কেমন জাদুর মতো বদলে দিলেন সব! যে দল আগের বছর ছিল পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে, তারাই সেবার হয়ে গেল সিরি বি’র সেরা। ফলাফল হিসেবে আবার সিরি আ-তে ফিরে গেল ব্রেসিয়া।

ব্রেসিয়ার হয়ে এরকম পারফরম্যান্সে তার দিকে চোখ পড়লো সে সময়ের ইন্টার মিলান কোচ মিরকা লুকেস্কুর। পিরলোকে দলে ভেড়ালেন তিনি। কিন্তু গতি কম হওয়ায় দলে সুযোগ হচ্ছিল না তার। রেজিনাতে লোনে দেয়া হলো তাকে। সেখানে দারুণ এক মৌসুম কাটালেন, কিন্তু লোন থেকে ফেরার পরেও একরকম ব্রাত্যই হয়ে রইলেন ইন্টারে, মাত্র চার ম্যাচে মাঠে নামতে পারলেন তিনি। ফলে আবার লোনে দেয়া হলো তাঁকে। যে ক্লাবের হয়ে তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, সেই ব্রেসিয়াতে। এই ব্রেসিয়াতেই ক্যারিয়ারের গতিপথ পুরোপুরি বদলে গেলো, ‘দ্য আর্কিটেক্ট’ হওয়ার যাত্রা শুরু হলো তার।

ব্রেসিয়াতে তখন খেলেন ‘ডিভাইন পনিটেইল’ খ্যাত স্টাইলিশ ফুটবলার রবার্তো ব্যাজিও। তার পজিশন ছিল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। কিন্তু তা হলে পিরলো খেলবেন কোথায়?

এই অবস্থায় ব্রেসিয়ার তৎকালীন কোচ কার্লো মাযোন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার জন্য গোটা ফুটবলবিশ্ব তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতেই পারে। পিরলোর পায়ে তেমন গতি ছিল না, কিন্তু ছিল বল দীর্ঘ সময় পায়ে ধরে রাখার ক্ষমতা। মাযোন তাই পিরলোকে নিয়ে এলেন আরও নিচে, ডিপ লাইং মিডফিল্ডার হিসেবে। সোজা কথায়, ফুটবল খেলা যদি হয় একটা অর্কেস্ট্রার নাম, তবে পিরলো হলেন তার কন্ডাক্টর। ফল পাওয়া গেল মৌসুমের শেষে। পিরলো আসার আগে যারা ধুঁকছিল অবনমনের শঙ্কায়, তারাই মৌসুম শেষ করল মোটামুটি একটি ভদ্র অবস্থানে থেকে।

ব্রেসিয়াতে যখন ছিলেন; Source: fourfourtwo.com

২০০১ সালে পিরলো যোগ দেন ইন্টার মিলানের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলানে। ক্যারিয়ার পুরোপুরিভাবে বিকশিত হলো এখানে। প্লে-মেকিং তো ছিল আগে থেকেই, সেই সাথে ফ্রি-কিককে পরিণত করলেন পিকাসোর তুলির আঁচড়ে। অনেকগুলো ট্রফি জিতেছেন মালদিনি, কাকা, ক্রেসপো, শেভচেঙ্কোদেরকে সঙ্গে নিয়ে। একটা সময়ে তার নাম আর এসি মিলান হয়ে গিয়েছিল সমার্থক।

এসি মিলানের জার্সিতে পিরলো; Source: telegraph.co.uk

সেই পিরলোকে ২০১১ সালে ছেড়ে দেয় এসি মিলান। এতদিনের ক্লাবের এমন আচরণে তিনি যখন স্তম্ভিত, তখনই পিরলোকে ফ্রি ট্রান্সফারে নিজেদের দলে ভেড়ায় জুভেন্টাস। এসি মিলানের ‘বাতিল মাল’ সাইন করানোয় অনেকেই ভ্রূ কুঁচকে থাকবেন হয়তো, কিন্তু পরের চার মৌসুমে জুভেন্টাসের টানা চার স্কুডেট্টো জয় সেই ভ্রূ কুঁচকানোকে পরিণত করেছে বিস্মিত দৃষ্টিতে। চোখ আরও কপালে উঠতে পারে, যদি জানা থাকে যে, ২০০৩ থেকে লিগবঞ্চিত ছিল জুভেন্টাস। সেখানে পিরলো আসার পরের চার মৌসুমেই চারবার।

সেই জুভেন্টাসও ছেড়ে দেন ২০১৫ সালে, যোগ দেন মেজর লিগ সকারের ক্লাব নিউ ইয়র্ক সিটিতে। জুভেন্টাস ছাড়ার সাথে সাথেই সবাই বুঝে যায়, বেজে উঠেছে বিদায়ের রাগিণী, সময়ের অপেক্ষা শুধু। সেখানে দুই বছর কাটানোর পরে ফুটবল বিশ্বকে বেদনায় ডুবিয়ে বিদায় বলে দেন আন্দ্রে পিরলো।

ক্লাব অথবা জাতীয় দলের হয়ে এক ইউরো ছাড়া জিতেছেন সম্ভাব্য সবকিছুই। ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন, এসি মিলানের হয়ে দুবার জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। আক্ষেপ থাকার কথা নয়, তারপরেও একটা বিশেষ রাতের কথা মনে পড়লে আক্ষেপে ছেয়ে যায় আন্দ্রে পিরলোর মন। রাতটা অন্য কোনো রাত নয়, ইস্তাম্বুলের মাঠে লিভারপুলের অসাধারণ কামব্যাকের সেই রাত।

নিজের অটোবায়োগ্রাফি ‘আই থিংক দেয়ারফোর আই প্লে’তে পিরলো নিজেই এ কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর ভাষায়, ইস্তাম্বুলের পরে খেলা ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করছিলাম আমি, কারণ সবকিছুই অর্থহীন মনে হচ্ছিল তখন। সেই রাতের কথা মনে পড়লে দমবন্ধ লাগত আমার। পথের শেষটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি এবং আমার ফুটবল ক্যারিয়ার দুটোই শেষ হয়ে গেছে।

ভাগ্যিস ছাড়েননি! কারণ এই ঘটনার এক বছরের মাথায় চতুর্থবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি, সাত ম্যাচের মধ্যে তিন ম্যাচেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়ে পিরলো ছিলেন তার প্রধান কাণ্ডারি।

বিশ্বজয়ী পিরলো; Source: pinterest.com

পিরলো সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। অনেকের মধ্যে আছেন জিয়ানলুইজি বুফন, কার্লো আনচেলত্তি, ইয়োহান ক্রুইফ, মার্সেলো লিপ্পির মতো ফুটবল ব্যক্তিত্বরাও। তবে পিরলো কী ছিলেন তা বোঝাতে জিয়ানলুইজি বুফনের একটি কথাই যথেষ্ট। পিরলো যখন ২০১১ সালে এসি মিলান ছেড়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন তখন কথাটা বলেছিলেন তিনি-

“আন্দ্রে যখন আমাকে বলল, ও জুভেন্টাসে যোগ দিচ্ছে, তখন শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল আমার। ঈশ্বর বলে অবশ্যই কেউ আছেন। ওর মতো লেভেল এবং দক্ষতার একজন খেলোয়াড় পাওয়াটাকে আমি বলব, ‘সাইনিং অফ দ্য সেঞ্চুরি’।’”

Featured Image: DeviantArt

Related Articles